সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়? সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠার পটভূমি-
সামন্ততন্ত্র - Feudalism |
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ → সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) হল - মধ্যযুগের ইউরোপের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রচলিত ভূমিকেন্দ্রীক ব্যবস্থা।
সামন্ত্রতন্ত্র বা সামন্তবাদ, ইউরোপের ইতিহাসে (মধ্যযুগ) এতো বেশি আলোচিত যে, 'মধ্যযুগকে' অনেক সময় সামন্ত্রতন্ত্রের যুগও বলা হয়।
অষ্টম শতকে ফ্রাঙ্কদের সময়কালে সামন্ততন্ত্র (Feudalism) বিকাশ-লাভ করেছিল। জার্মানী, স্ক্যান্ডিনেভিয়া,ইটালী, স্পেনেও সামন্ততন্ত্র (Feudalism) দেখা যায়। নরম্যানদের শাসনকালে সামন্ততন্ত্র বা 'Feudalism' প্রধানত Warlords এবং land barons দের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভাজন এবং তার ভিত্তিতে সমাজ কাঠামো গঠনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
G. Gurvitch এবং M. Bloch কে অনুসরণ করে Fernand Braudel বলেন, মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজে নানান ধরণের সমস্যা ছিল এবং কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার কার্যকরী বিষয় ছিল 'Feudalism'
জার্মান ঐতিহাসিক F. L. Ganshof তাঁর 'Feudalism' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, “মধ্যযুগে ইউরোপে একখণ্ড জমিকে কেন্দ্র করে কতকগুলো ভিন্ন ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল।
এই ব্যবস্থায় একজন আর একজনকে জমি দান করবে। জমি প্রদানকারী হলেন-লর্ড এবং জমি যিনি গ্রহণ করেছেন তিনি হলেন-ভ্যাসাল।
এই লর্ড ও ভ্যাসালের মধ্যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছিল, তাকে সাধারণ অর্থে সামন্ততন্ত্র বা সামন্ততন্ত্র (Feudalism) বলা হয়।
- (Fief বা Feud-এর অর্থ হল-একখণ্ড জমি বা একটি রাজ্য। এই Fief বা Feud শব্দ থেকেই 'Feudalism' শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করা হয়। যে ব্যক্তি Fief প্রদান করে তিনি 'Lord' নামে পরিচিত। যে ব্যক্তি Fief গ্রহণ করেন তিনি Vassal নামে পরিচিত )
লাতিন শব্দ Feodalis ও ফরাসি শব্দ Feodalite, শব্দ থেকেই ইংরেজি শব্দ Feudalism বা সামন্ততন্ত্র শব্দটির উদ্ভব।
'Dictionary of Sociology'-তে সামন্ততন্ত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সামন্ততন্ত্র ভূমিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যবস্থা।
Stubbs বলেন, সামন্ততন্ত্র হল এমন একটি ব্যবস্থা যে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভূমিই প্রধান। ইউরোপে জমির স্বত্ত্বকে কেন্দ্র করে একদিকে রাজা, অন্যদিকে ভূস্বামী এবং অধস্তন প্রজাদের নিয়ে যে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) নামে পরিচিত ছিল।
২। সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠার পটভূমি আলোচনা করঃ
উত্তর → Thompson and Johnson লেখা “An Introduction to Medieval Europe” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রোমান, খ্রিস্টান এবং জার্মান ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ছিল সামন্ততন্ত্র। সমসাময়িক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে নতুন ধরনের নমূনা হিসাবে সামন্ততন্ত্রকে অভিহিত করা যায়।
ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল আনুমানিক পঞ্চম (৫) থেকে দশম (১০) শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে। ইউরোপ ছাড়া অন্যান্য দেশে সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব আগেই ঘটেছিল। চীনে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক তৃতীয় শতাব্দীতে। ভারতবর্ষে, চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। আরবে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের সময়কাল নবম ও দশম শতাব্দীতে। ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের সময়কাল হিসাবে দশম ও একাদশ শতাব্দীকে চিহ্নিত করা হয়। জার্মানিতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় দ্বাদশ শতাব্দীতে। ইংল্যাণ্ডে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে। ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নর্মাঙির ডিউক উইলিয়াম ইংল্যাণ্ডে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। মধ্যযুগের ইরোপে রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সামন্ততন্ত্রের গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়।
সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজব্যবস্থার বিকাশের একটি স্তর। শার্লামেনের মৃত্যুর পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ 'বিশৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক আক্রমণের ফলস্বরূপ সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।
মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব হঠাৎ করে হয়েছিল এমনটা নয়, সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) ছিল দীর্ঘসময়ের ফসল। দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যাবার পর সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব বিভিন্ন অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ইটালী, জার্মানি, স্পেন, স্কটল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশগুলিতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ঐতিহাসিক F.L. Ganshof দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে "Classical Age of Feudalism” বা “সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ” বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ এই সময়কালেই ঘটেছিল। রোমান সাম্রাজ্যে ‘প্যাট্রোসিনিয়াম’ (Patrocinium) নামক এক ধরনের ব্যবস্থা ছিল। ধনী ব্যক্তিরা ক্লায়েন্ট (Client) নামক এক ধরনের ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। Client-রা ধনী ব্যক্তিদের অনুগ্রহভাজন ছিল এবং এরজন্য তারা ধনীদেরকে শ্রমদান করত। জার্মান কমিটেটাস (Comitatus) হল প্যাট্রোসিনিয়ামের অনুরূপ শব্দ। রোমান সাম্রাজ্যের শেষদিকে প্যাট্রোসিনিয়াম ব্যবস্থা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভবের ক্ষেত্রে ‘প্যাট্রোনেজ প্যাট্রোসিনিয়াম' (Patronage Patrocinium) প্রথার কথা বলা যায়।
ফ্রাঙ্করা কমিটেটাস (Comitatus) নামক প্রথাটির সঙ্গেও পরিচিত ছিল। সামরিক যোদ্ধাগণ যদি তাদের নেতার অধীনে তাঁর স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন তা ‘কমিটেটাস' পদ্ধতি হিসাবে অভিহিত হত। Perry Anderson-3 ‘কমিটেটাস’, প্যাট্রোসিনিয়াম প্রথার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভবের ক্ষেত্রে ‘প্যাট্রোসিনিয়াম’ ‘কমিটেটাস’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভবের ক্ষেত্রে Fief বা 'Feudom'-এর বিষয়টি এসে পড়ে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে F. L. Ganshof, Elizabeth, A. R. Brown প্রমুখরা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে Fief বা Feudom-কে অপরিহার্য উপাদান বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও প্রায়র এই বিষয়টি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, Fief বা Feudom না থাকলেও সামন্ততন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে কোন সমস্যা হত না।
Thompson এবং Johnson-এর বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায় যে, সামন্ততন্ত্র বা সামন্তবাদ (Feudalism) রোমান ও জার্মান সমাজব্যবস্থার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল। জার্মানরা রোমান ব্যবস্থা ধ্বংস করে ধ্রুপদী যুগের অবসান ঘটানোর ফলে সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
বেলজিয়ামের ঐতিহাসিক Henry Pirenne মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব প্রসঙ্গে যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা "পিরেনের তত্ত্ব" নামে পরিচিত। অষ্টম শতকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য পশ্চিম ইউরোপের বাণিজ্যের অবলুপ্তি ঘটে এবং মুদ্রা অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ইউরোপ গ্রাম্য কৃষিভিত্তিক সমাজে ফিরে যায় এবং সামন্ততন্ত্রের বা সামন্তবাদ (Feudalism) উদ্ভব ঘটে। কিন্তু হেনরি পিরেনের তত্ত্বের সমালোচনা ও বিরোধীতা করে উপশক বা উপস্ বলেছেন, ভূমধ্যসাগরে মুসলমানদের কর্তৃত্ব স্থাপনের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার দ্রুত অবসান হয়নি।
0 Comments
Thank you for contacting jibonta.in! Please let us know how we can help you.