বাবরের প্রার্থনা
রচনাকাল:
১৯৭৪ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটি রচিত হয় । কবিতাটিতে ৬টি স্তবক, ২৪ টি পঙ্কতি রয়েছে। তৎকালীন, বাংলা তথা ভারতবর্ষের (১৯৭৪ সাল) এক বিশাল দুঃস্বপ্নের কাল ছিল।সেই সময় সারাদেশ জুরে জরুরি অবস্থা, তৎকালীন যুব সমাজ এক অতি ভয়ঙ্কর বিভীষিকায় দ্বারা দিশাহারা ওঠে।
তৎকালীন দেশের রাজনীতি, মানুষের স্বাভাবিক দিনগুলিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নখের দ্বারা অস্বাভাবিক করেছিল। যত্র-তত্র খুন বা হত্যা, হিংসা, মারামারি এই সবে চারিদিক রক্তাত হয়ে উঠেছিল। সারা দেশ তখন দিশাহিন, যেন অসুস্থ রোগের প্রকোপে শুয়ে আছে মৃত্যুশয্যায়। এই রকম এক অস্বাভাবিক পরিবেশে কবি শঙ্খ ঘোষের ব্যাক্তিগত জীবনের দুঃখের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৪ সালে, হেমন্তের এক সন্ধ্যায় এই কবিতাটি রচনা করেন।
জেনেছি যে কবির কন্যা কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ভাল ভাবে চিকিৎসা না হওয়ায় দিনে-দিনে তার, কন্যার রোগ আরও বেড়ে যেতে শুরু করে, মিলিয়ে যেতে শুরু করে, তার কন্যার লাবণ্য, অথচ এই কিশোরী মেয়েটির অর্থাৎ কবি শঙ্খ ঘোষের কন্যার তখন ফুলের মতো ফুটে ওঠার বয়স। তাই কবির মন খুবই বিষন্ন ছিল, কবি কোন কাজে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না।
সেরকম এক সন্ধ্যার প্রাক্কালে নির্জন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাচারি করতে করতে, কবির মনে হঠাৎ মনে পরে এক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা। মুঘল সম্রাট বাবর-এর পুত্র হুমায়ুন যখন কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিলেন না, তখন বাবর একদিন নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, তাঁর পুত্র হুমায়ূন যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে বাবর-এর পুত্র হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সম্রাট বেশিদিন বাঁচেন নি। এই ছোট্ট ঐতিহাসিক তথ্যটির দ্বারা আলোচ্য কবিতাটিতে কবি এক নব-তাৎপর্য দান করেন ।
পিতার প্রার্থনা, গুরুজনদের আশীর্বাদ ও মঙ্গলকামনায় কোন পুত্র বা পুত্রসম স্নেহজনদের আরোগ্যলাভ ঘটে কিনা, তা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সাপেক্ষ হলেও, মানুষের সত্য-কামনায়, সত্যনিষ্ঠায় ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের ঐকান্তিকতায় যে মনের জোর আসে, তার দ্বারা মানুষ কখনো কখনো অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায়।
মহাপুরুষদের জীবনীকাহিনিগুলিতে এই রকম অনেক ঘটনার কথা আছে। যেগুলিকে অলৌকিক বলে উড়িয়ে না দিয়ে যদি এইভাবে ভাবতে পারি যে, শুধু বিশ্বাসের দ্বারা অসাধ্যকে সাধন করেছেন। এই যুগে এই সেদিন মাদার টেরেসার অলৌকিক শক্তির কথা খ্রিস্টান সমাজ সারা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের সামনে স্বীকার করেছেন। হয়তো কিছুটা ঘটনা, কিছুটা বিশ্বাস মিলিয়ে তৈরি হয় মিথগুলি।
‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটির বিষয়বস্তু:
হুমায়ূনের জন্য বাবরের ঐকান্তিক প্রার্থনার সত্যটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ প্রার্থনা জানিয়েছেন পরম শক্তিমানের কাছে কন্যার রোগমুক্তির।
প্রতিদিন পুলিশের গুলিতে বা ঘাতকের ছুরিতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেশ। দেশের যুব সমাজ আজ অসুস্থ বাবরের পুত্রের মতো, মৃত্যুর প্রহর গুনে চলেছে। শুধু কবির নয়, যেকোন পিতার যে কোন পুত্র আজ রোগশয্যায়। কবি একজন স্নেহময় পিতারূপে তাদের সকলের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন। তিনি প্রার্থনা জানিয়েছেন এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে সেই তরুণ-যুবকদের জীবন লাভ ঘটুক।
“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”
শত-সহস্র তরুণ-তরুনীর জন্য কবি কাতর। শত-শত শুষ্ক মুখের ঘুরে বেড়ানো ছাত্রদের জন্য উদ্বিগ্ন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর অনুভূতিশীল মনে তাদের কষ্টকে ভুলতে পারেননি বলেই নিজের কন্যার কথা ভাবতে ভাবতে তার চিন্তার সরণিতে এসে পৌঁছেছে সম্রাট বাবরের কথা, আরও বৃহত্তর ভাবে সমগ্র দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের কথা। যেমন সন্ত্রাসবাদের যুগে মানসিক যন্ত্রণায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
"আমি যে দেখিনু-তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায়-মরেছে পাথরে নিস্ফল মাথা কুটে।"
সেই যন্ত্রণা, সেই আবেগ, কবি শঙ্খ ঘোষকেও স্পর্শ করেছে। তাঁর মনে হয়েছে এই সরলমতি যুবসমাজ আজ যে দিশাহারা, মৃত্যুর মুখোমুখি, অসুস্থ, তার জন্য তাদের কোন দায় নেই। পিতার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। সভ্যতা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ নারকীয় গতিতে ধ্বংস করতে আসছে মানুষের জীবনকে। দুর্নীতি, পাপ, অন্যায়, শঠতায় ছেয়ে গেছে দেশ। সকলের শুদ্ধচৈতন্যের জাগরন না ঘটলে এই যুব সমাজ কি করে মুক্তি পাবে!
“নাকি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোন প্রাণ নেই ভবিষ্যতের
আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যুকে ডেকে আনি নিজের ঘরে।”
যদি মানুষ নতজানু (জানু কথার অর্থ - হাঁটু ) হয়ে প্রার্থনায় না বসে, যদি পাপ হিংসা লোভ কে জয় করে শুদ্ধ চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে না পারে, তবে একদিন এই বর্বর আগুনের ঝলসানিতে সব পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ কোন পিতা, কোন বিবেকবান মানুষ তা চান না। তাই কবিতাটির শেষ স্তবকে এসে তিনি নিজেকে নিঃশেষ করতে চান, নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে আত্মজকে রক্ষা করতে চান।
“ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”
সমাজ-সচেতন মানবতাবোধের দলিল হিসাবে কবিতাটি সার্থক হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত বা MCQ প্রশ্নোত্তর
1) বাবরের প্রার্থনা কবিতাটির কবি শঙ্খ ঘোষ নিজের কথা বলতে গিয়ে কোন মুঘল সম্রাটের কথা বলেছেন ?
- বাবর ( প্রথম মুঘল সম্রাট)
2)এইতো 'জানু' পেতে বসে আছি এই - জানু কথার অর্থ কি?
- জানু কথার অর্থ - হাঁটু
3) বাবরের প্রার্থনা কবিতার কবি শঙ্খ ঘোষ জানু পেতে বসে আছেন কোন দিকে ?
- পশ্চিম দিকে
4) বাবরের প্রার্থনা কবিতার কবি শঙ্খ ঘোষ কোন ঋতুর কথা আলোচনা করেছেন ?
- বসন্ত ঋতু
5) আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক পঙক্তিটি কতবার আলোচিত হয়েছে ?
- তিন বার
6) বাবরের প্রার্থনা কবিতাটির কত গুলি স্তবক ?
- ছয় টি (৬ টি)
7) চোখের কোনে এই সমূহ 'পরাভব'।
- এই 'পরাভব' কথার অর্থ কি ?
- পরাভব কথার অর্থ - পরাজয় বা হার।

3 Comments
Thanks
ReplyDeleteNice
ReplyDeleteIt's really super helpful thank you soo much 😭🤌🏼
ReplyDeleteThank you for contacting jibonta.in! Please let us know how we can help you.