রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ - সাহিত্যের সামগ্রী - সংক্ষিপ্ত,রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ - সাহিত্যের সামগ্রী 

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ - সাহিত্যের সামগ্রী

সাহিত্যের সামগ্রী Pdf  Download link 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। 'সাহিত্যের সামগ্রী' কোন শ্রেণীর রচনা? 

  • উত্তর। 'সাহিত্যের সামগ্রী' সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ।

প্রশ্ন ২। সাহিত্যের সামগ্রী' কোন সময়ে রচিত? কোন পত্রিকায় প্রকাশিত? 

  • উত্তর। ‘সাহিত্যের সামগ্রী' কার্তিক ১৩১০ বঙ্গাব্দে রচিত এবং ঐ মাসেই নবপর্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

প্রশ্ন ৩। ‘সাহিত্যের সামগ্রী' রবীন্দ্রনাথের কোন প্রবন্ধ সংকলনে সংকলিত? সেটি কত সালে প্রকাশিত?

  • উত্তর। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত। ‘সাহিত্য' গ্রন্থটি ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত।

প্রশ্ন ৪। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সামগ্রী বলতে কী বুঝিয়েছেন?

  • উত্তর। রবীন্দ্রনাথের মতে “যে সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রং ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না, ইহাকেই সাহিত্যের সামগ্রী বলা হয়। 

প্রশ্ন ৫। লেখকদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কাকে নির্দেশ করেছেন?

  • উত্তর। রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে, লেখকদের প্রধান লক্ষ্য পাঠক সমাজ।

প্রশ্ন ৬। রচয়িতারা কেন রচনা করেন?

  • উত্তর। রচয়িতারা পাঠকের মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করতে চান, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা লাভ করতে চান। আর সেখানে পৌঁছবার জন্যই ভাবের কথা ব্যক্ত ক’রে রচনা করেন।

প্রশ্ন ৭। জ্ঞানের বিষয় নয়, ভাবের বিষয়ই সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। – কেন?

  • উত্তর। জ্ঞানের বিষয় একবার জানা হয়ে গেলে আর তার প্রতি আগ্রহ থাকে না, কিন্তু ভাবের বিষয় বারবার জানলেও পুরনো হয় না। এই জন্যেই ভাবের বিষয় সাহিত্যের অবলম্বন হয়।

প্রশ্ন ৮। জ্ঞানের কথা এবং ভাবের কথা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবার পদ্ধতি কী? 

  • উত্তর। রবীন্দ্রনাথের মতে, জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করিতে হয়, আর ভাবের কথাকে সার করিয়া দিতে হয়। 
প্রশ্ন ৯। ভাব, বিষয়, তত্ত্ব, রচনা এ গুলোর মধ্যে কোনটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির 
  • উত্তর। রচনা সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজস্ব। তাই, কারো রচনা অন্য কারো মতো হতেই পারে না। 
প্রশ্ন ১০। লেখক কিসের মধ্যে অমরত্ব লাভ করতে পারেন? কেন?
  • উত্তর। লেখক তাঁর রচনার মধ্যে বেঁচে থাকেন। রচনাই তাঁর নিজের; ভাব, বিষয়তত্ত্ব—এ সব সাধারণের। কত মানুষ কতভাবে তার প্রকাশ ঘটাবে। যাঁর রচনা যত বিশেষত্ব পূর্ণ হয়, তিনি তত অমরত্ব লাভ করেন। 
প্রশ্ন ১১। সাহিত্য ও ললিতকলা বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন? 
  • উত্তর। রবীন্দ্রনাথের মতে, “ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিত কলা। 
প্রশ্ন ১২। “এই একান্ত আকাঙ্ক্ষায় কত প্রাচীন কাল ধরিয়া কত ইঙ্গিত, কত ভাষা, কতলিপি.....” এখানে কোন 'আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছে?
  • উত্তর। “এই একান্ত আকাঙ্ক্ষায় কত প্রাচীনকাল....“এখানে 'আকাঙ্ক্ষা' বলতে বোঝানো হয়েছে মানুষের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করার, অমরতা লাভ করার আকাঙ্ক্ষাকে।
প্রশ্ন ১৩। নিজের এবং নিজের ভাবনার অমরতা লাভের জন্য কী কী মানুষ এ পর্যন্ত করেছে ব'লে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন?
  • উত্তর। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, মানুষ মানুষের মাঝে অমরতা লাভের জন্য এ পর্যন্ত ভাষা এবং লিপির উদ্ভব ঘটিয়েছে, পাহাড়ের গায়ে, গাছের ছালে, মন্দিরগাত্রে, কাগজে, চামড়ায় সেই লিপিতে ভাবের কথা লিখে রেখেছে—কেউ খোদাই ক'রে, কেউ কালিতে; কেউ বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, কেউ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে।
প্রশ্ন ১৪। 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কোন সম্রাটকে স্মরণ করেছেন? কোন প্রসঙ্গে?
  • উত্তর। ‘সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্রাট অশোককে স্মরণ করেছেন। মানুষ যে মনের ভাবকে বা বক্তব্যকে চিরকালের মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়ে অমরতা চায়, তার জন্য বক্তব্যকে পাহাড়ের গায়ে, ধাতব পদার্থে খোদাই করে রাখে, — এই কথা বলার প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে সম্রাট অশোকের শিলালিপির কথা স্মরণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন ১৫। “পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন।”— কে কীভাবে পাহাড়কে কথা কহিবার ভার দেন?
  • উত্তর। পাহাড়কে ‘কথা কহিবার ভার’ দিয়েছিলেন সম্রাট অশোক। তিনি নিজের বক্তব্য বা ভাবের কথা পাহাড়ের গায়ে খোদাই করিয়ে সেই কথা উত্তর কালের মানুষদের বলবার ভার দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন ১৬। মানুষের মাঝে অমরতা লাভের কয়টি মাধ্যমের বা উপায়ের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন?
  • উত্তর। অমরতা লাভের জন্য চারটি মাধ্যমের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন; যথা —  
  1. সাহিত্য, 
  2. ভাস্কর্য, 
  3. চিত্র এবং 
  4. স্থাপত্য। 
  • অর্থাৎ, ভাবের কথা কবিতা, নাটক, গল্প ইত্যাদির আকারে লেখা যায়, মূর্তি খোদাই করা যায়, চিত্র অঙ্কন করা যায়, কিম্বা মঠ, মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করা। যায়।

প্রশ্ন ১৭। বহু সহস্র বৎসর পরে সেই দ্বীপ হইতে একটি বিদেশী আসিয়া কালান্তরের। সেই মুক ইঙ্গিতপাশ হইতে তাহার ভাষাকে উদ্ধার করিয়া লইলেন।" কোন দ্বীপের কথা বলা হয়েছে? সেই দ্বীপ থেকে কোন বিদেশী এসে কোন ভাষা উদ্ধার করেন?
  •  উত্তর। দ্বীপটির নাম ইংল্যান্ড; বিদেশীর নাম লর্ড কানিংহাম। তিনি বহুদিন মূক হয়ে থাকা আশোকের শিলালিপির বক্তব্য উদ্ধার করেন।
প্রশ্ন ১৮। 'সারবান সাহিত্য' কী? তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য কী? 
  • উত্তর। যে সাহিত্যে জ্ঞানের বিষয় থাকে, তথ্য পরিবেশিত থাকে, তাই সারবান সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘সারবান সাহিত্য'—এর স্থায়িত্ব কম। কারণ, জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে আর তার প্রয়োজন থাকে না।
প্রশ্ন ১৯। সাহিত্যের ভাবের সঙ্গে রচনার সম্পর্ক কী? ভাব ও রচনার মধ্যে কোনটা সাহিত্যিকের নিজস্ব ?
  • উত্তর। সাহিত্যের ভাবের অঙ্গ হ’ল রচনা। দেহ বা অঙ্গ না থাকলে যেমন ব্যক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না, তেমনি রচনা ছাড়া সাহিত্য হয় না। ভাব এবং রচনার মধ্যে রচনাই সাহিত্যিকের নিজস্ব।
প্রশ্ন ২০। কবি-সাহিত্যিকেরা কিসের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকেন?

  • উত্তর। কবি-সাহিত্যিকেরা নিজের নিজের রচনার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকেন।
প্রশ্ন ২১। কবি-সাহিত্যিকগণ কীভাবে উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করেন?
  • উত্তর। যথার্থ প্রতিভাসম্পন্ন কবি-সাহিত্যিকেরা প্রথমে সাধারণের ভাবকে, বাইরের জগৎকে নিজের করে তোলেন, তারপর বিশেষ রূপে-নিজের মতো করে সকলের করে তোলেন। তখনই তা’ সাহিত্য হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন ২২। সাধারণ সত্য আর সাহিত্যের সত্যে পার্থক্য কতটা?
  • উত্তর। সাধারণ সত্য ব্যক্তি নিরপেক্ষ; কিন্তু, সাহিত্যের সত্য ব্যক্তিসাপেক্ষ ব্যাক্তিভেদে বিচিত্র রকমের হয়। তা
প্রশ্ন ২৩। সাহিত্য 'আবিষ্কার নহে, অনুকরণ নহে', তবে কী?
  • উত্তর। সাহিত্য ‘আবিষ্কার নহে, অনুকরণ নহে, তা’ সৃষ্টি। নতুন কিছু।

সংক্ষিপ্ত রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। “প্রকাশই কবিত্ব, মনের তলার মধ্যে কী আছে বা না আছে তাহা আলোচনা করিয়া বাহিরের লোকের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই।”― কে কোথায় এই উক্তি করেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য বুঝিয়ে বলো।

উত্তর। “প্রকাশই কবিত্ব, ..."—উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্য' গ্রন্থে সংকলিত ‘সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে বলেছেন। 
সাহিত্যের সামগ্রী কী—এ প্রশ্নের মীমাংসার পূর্বেই লেখক আর একটি প্রশ্নের মীমাংসা করতে চেয়েছেন, তা হ'ল কবিত্ব কী। আমাদের মধ্যে অনেকে ভাবুকতাকে কবিত্ব মনে করেন। কিছু প্রকাশ না করলেও, না লিখলেও তাকে বলা হয় নীরব কবিত্ব। রবীন্দ্রনাথ নীরব কবিত্বকে স্বীকার করেন না। যে কাঠ জ্বলে নি, তাকে আগুন বলা যেমন ভ্রান্তি, তেমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে বিভোর হয়ে আকাশেরই মতো নীরব থাকলে তাকে কবিত্ব বলাও ভ্রান্তি। কবিত্ব হল প্রকাশ ক্ষমতা। বাইরের পরিস্থিতির প্রভাবে মানুষের মনে নানা রকমের ভাব জোগে উঠতেই পারে। একই ঘটনা দেখে কারো মনে আনন্দ, কারো মনে বেদনা জাগতে পারে। কিন্তু কোন্ ভাব জেগেছে, সেটা বোঝা যায় প্রকাশ দেখেই। প্রকাশ না ঘটলে অন্য কারো পক্ষে সেই ভাবের অস্তিত্ব জানা বা আস্বাদন করা সম্ভব নয়। যখন ব্যক্তি তাঁর মনের ভাবকে নানা রকম রচনার মধ্যে দিয়ে অন্যের মনের কাছে পৌঁছে দেন, অন্যকেও সেই ভাব ও ভাবনায় উজ্জীবিত করে তোলেন, তখন সেই কাজটাই হ’ল কবিত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলব, অন্তরের ভাব ও বক্তব্যকে আস্বাদনযোগ্য করে পরিবেশন করার প্রতিভা ও প্রবণতা হ'ল কবিত্ব। নীরব কবিত্ব বলে কিছু হয় না।

প্রশ্ন ২। “আমাদের মনের (Moner) ভাবের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই এই, - সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করিতে চায়।"—কার কোন রচনার অংশ? মানুষ কীভাবে তার এই চাওয়াকে সার্থক করতে চায়?

উত্তর।"আমাদের মনের (Moner) ভাবের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই এই,....." -উদ্ধৃতিটি রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ 'সাহিত্যের সামগ্রী’-র অংশ।

মানুষের স্বাভাবিক একটা প্রবৃত্তি বা আকাঙ্ক্ষা, সে অন্য মানুষের মনের মধ্যে নিজের ভাবকে, উপলব্ধিকে অনুভব করবে, চিরকাল টিকে থাকবে অমরতা লাভ করবে। আর এটা করার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত থাকে না। মানুষ জানে, একদিন সে শেষ হয়ে যাবে, তার জিনিষপত্র, বাড়ি-ঘর, সম্পদ, আপনজন—সব শেষ হয়ে যাবে; তবে, তার ভাবনা, তার অনুভূতি, উপলব্ধ সত্য অন্য মানুষের মনের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন মনের ভাব বা বিশেষ উপলব্ধ বিষয়কে বিশেষ ভাবে প্রকাশের মাধ্যমে অন্যদের মনের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজটা করার জন্যই মানুষ সেই প্রাচীন কাল থেকে কত কিছু করেছে, এখনও করে চলেছে। জন্ম হয়েছে ভাষার উদ্ভাবন হয়েছে লিপির, সেই লিপিতে মনের ভাব লিখে রাখা হয়েছে কঠিন পর্বতগাত্রে, গাছের ছালে, ধাতব বস্তুতে, কাগজে... লেখা হয়েছে বাম দিক থেকে ডান দিকে, ডান দিক থেকে বাম দিকে, এক পঙক্তি থেকে অন্য পঙ্ক্তিতে। লিখলেই যে তা অন্যের মনে জায়গা পায় তা নয়, কতকাল হয়তো মানুষের সান্নিধ্য থেকে দূরে অবহেলায় পড়ে থাকে; তবু আশা, কোনো একদিন, কোনো মানুষ তাকে উদ্ধার করবে, মনে জায়গা দেবে; পছন্দ হলে হয়তো আরো অনেকেরই মনে জায়গা পাবে। হারিয়ে যাওয়া ভাবও সজীবতা পাবে। সম্রাটের (অশোকের) শিলালিপির বক্তব্য দুই সহস্রাধিক বৎসর পরেও মানুষ জেনেছে, বুঝেছে, মনে জায়গা দিয়েছে। অশোকের শিলালিপি সাহিত্য নয়, তাও আছে; সাহিত্য হলে তো মানুষ তাকে সাদরে মনের মধ্যে বহন করে চলবে; যেমন বাল্মীকি, কালিদাস, ভবভূতি প্রমূখের কাব্য-ভাবনা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি— কবিদের অমর করে রেখেছি।

প্রশ্ন ৩। “অশোকের সেই মহাবাণীও কত শত বৎসর মানব হৃদয়কে বোবার মতো কেবল ইশারায় আহ্বান করিয়াছে।”-অশোকের মহাবাণী বলতে কী বোঝানো হয়েছে? তা মানব হৃদয়কে বোবার মতো আহ্বান করেছে কেন? বুঝিয়ে বলো।

 উত্তর। “অশোকের সেই মহাবাণী" বলতে অশোকের শিলালিপিতে খোদিত বৌদ্ধ ধর্মের বাণীর কথা বোঝানো হয়েছে। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মের মহান বাণীকে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে। দেবার জন্য তা পাথরে খোদাই করেছিলেন। সেই শিলালিপি শত শত বৎসর অক্ষত থাকল। কিন্তু যে ভাষায় তা লেখা হয়েছিল, সেই ভাষা আর মানুষের মুখে প্রচলিত থাকল। ভাষা পাল্টে গেল, লিপি পাল্টে গেল। উত্তরকালে যে মানুষের আবির্ভাব ঘটল, তারা কেউ অশোকের শিলালিপির ভাষা বুঝতে পারল না। কৌতূহল থাকলেও কেউ লিপির বক্তব্য বুঝতে পারল না। অশোকের পর ভারত শাসন করেছেন কতজনে; তারা কেউ অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেন নি। রাজপুত, পাঠান, মোগল, বার্গ—কোনো গোষ্ঠীর মানুষ শিলালিপির বক্তবা বুঝতে পারেন নি। সেইজন্যেই ঐ শিলালিপিকে, তার বক্তব্যকে মূক আহ্বান বলা হয়েছে। তবে ভারতের কেউ অশোকের শিলালিপির বক্তব্য উদ্ধার করতে না পারলেও জন্মসূত্রে জার্মানী, ব্রিটিশ নাগরিক ফ্রেড্রিক ম্যাক্সমূলার ইংল্যান্ড থেকে এদেশে এসে প্রত্নবিষয় নিয়ে প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনিই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে শিলালিপির মৌনব্রত ভঙ্গ করেন।

প্রশ্ন ৪। “সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের(Gyan) বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।”- কে কোন রচনায় এই মন্তব্য করেছেন? মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর। “সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের (Gyan) বিষয় নহে..”- একথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের সামগ্রী' রচনায় বলেছেন।মানুষের দু'রকম/প্রকার আলোচনার বিষয়—
  1. জ্ঞানের বিষয়, আর 
  2. ভাবের বিষয়।    
   জ্ঞানের বিষয়:
সাধারণত, উপভোগ্য বা আস্বাদনীয় হয় না, কিন্তু ভাবের বিষয় ঠিক মতো পরিবেশন করতে পারলেই তা আস্বাদনযোগ্য হয়। জ্ঞানের বাইরের, আর ভাবের কথা ভিতরের। জ্ঞান বাস্তবমুখী, বিচার সাপেক্ষ বা যুক্তিধর্মী এবং ব্যক্তি নিরপেক্ষ; কিন্তু ভাব যুক্তিধর্মী হতে পারে না তা ব্যক্তিনিষ্ঠও। আমার ভাব আমারই মতো, আর কারো ভাবের সঙ্গে তার মিল নাও হতে পারে। জ্ঞানের জিনিস প্রচার করতে হয়, যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়; একবার তার প্রতিষ্ঠা হলে, জানা হয়ে গেল আর তার প্রতি কারো আগ্রহ বা কৌতূহল থাকে না। জানা বিষয়কে নতুন করে কেউ জানতে এলে তার প্রতি বিরক্ত না হয় পারা যায় না।

অন্যদিকে, ভাবের বিষয় প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাকে জানার শেষ নেই। তা আকাশের মতো সীমাহীন। তার বৈচিত্র্যের শেষ নেই। তাই, একই ভাব কারবার জানলেও আগ্রহ ফুরায় না, বরং বাড়ে। সাহিত্যের লক্ষ্য পাঠকের মন। সেই মনে জায়গা পেলে তবেই সাহিত্যিকের টিকে থাকা, অমরতা পাওয়া। তাই, যে বিষয়ের আকর্ষণীয় প্রকাশ ঘটাতে পারলে অমরতা লাভ করা যায়, সেই ভাবের বিষয়ই হবে সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন।

প্রশ্ন ৫। "রচনার মধ্যেই লেখক (Lekhok) যথার্থরূপে বাঁচিয়া থাকে; ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে।”—কথাটি কে কোথায় বলেছেন? কথাটির তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর। “রচনার মধ্যেই লেখক যথাৰ্থৰূপে বাঁচিয়া থাকে; ...” কথাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে বলেছেন।

মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে টিকিয়ে রাখা, মানুষের মনে অমরতা লাভ করা। আর সেইজন্যই প্রতিভাবানেরা নিজের মনের ভাবকে, নিজের মনের উপলব্ধ বিষয়কে শিল্প সম্মতভাবে প্রকাশ করেন। যতক্ষণ প্রকাশ না হয়, ততক্ষণ অন্যের মনে জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রকাশটাই নিজেকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেবার যথার্থ পথ। সাহিত্যে প্রকাশ হল রচনা। ভাষা আর লিপির সাহায্য নিয়ে অন্তরে জেগে ওঠা ভাব বা উপলব্ধ বিষয়কে প্রকাশ করার নামই রচনা। এই রচনা একান্তই লেখকের। একইভাব বহুজনের মধ্যে জাগতেই পারে। তার নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্য বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই ভাবের প্রকাশ হিসেবে ব্যক্তি যা সৃষ্টি করেন—কবিতা, নাটক, গল্প যাইহোক, তা একেবারেই তাঁর নিজস্ব। এই রচনার মান বা শিল্প-নৈপুণ্য যার যত বেশি, তিনি তত অন্যের মনে জায়গা করে নিতে পারেন। আর যিনি যত বেশি মানুষের মনে জায়গা নিতে পারবেন, তাঁর ভাবের মধ্যে, রচনার মধ্যে বেঁচে থাকাটাও ততই নিশ্চিত হবে। এজন্যই লেখক উদ্ধৃত কথাটি বলেছেন।


রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধের মূল বক্তব্যটি নিজের ভাষায় লেখ ।

 উত্তর। রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্য' গ্রন্থের একটা বিশিষ্ট প্রবন্ধ ‘সাহিত্যের সামগ্রী। সাহিত্যের যথার্থ সামগ্রী কী? সে সম্পর্কেই আলোচনা করতে চান। সাহিত্যিক যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন তা নিজের আনন্দের জন্যেই নয়, তাঁর লক্ষ্য পাঠক সমাজ। কারণ, লেখকের মনের জগৎ বা অনুভূত ভাবরাশি যতবেশি অন্যলোকের মনে সঞ্চারিত হয়, তাঁর তৃপ্তিও ততই বেশি হয়। মানুষের হৃদয়ের প্রধান আকাঙ্ক্ষা, অন্য সবার মনে স্থান লাভের মধ্যে দিয়ে অমরত্ব লাভ করা। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি। মানুষের মনে জায়গা পাওয়া উদ্দেশ্য বলেই সাহিত্যে অবলম্বিত হয় ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। “যাহা জ্ঞানের কথা তাহা প্রচার হইয়া গেলেই তাহার উদ্দেশ্য হইয়া শেষ হইয়া যায়।...হৃদয় ভাবের কথা প্রচারের দ্বারা পুরাতন হয় না।

জ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে আর জানবার ইচ্ছে কারো হয় না; কিন্তু হৃদয় ভাবের কথা বার বার জানলেও শান্তি হয় না। সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়, এ তথ্য জানবার আগ্রহ আমাদের নেই ; কিন্তু সূর্যোদয় কালের সৌন্দর্য বারবার উপভোগ করলেও অনাগ্রহ জন্মায় না। তাই সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে যদি মানুষের মনে জায়গা পেতে হয়। তাহলে সে সাহিত্যের বিষয় হবে অবশ্যই ভাবের কথা। “এই জন্য সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন জ্ঞানের (Gyan) বিষয় নহে, ভাবের বিষয়।”

একথাও ঠিক, ভাবের বিষয় হলেই তা যথার্থ সাহিত্য হয়ে ওঠে না; অন্যের মনে সঞ্চার করে দেবার জন্য তার উপযুক্ত মাধ্যম চাই। জ্ঞানের বিষয়কে পৌঁছে দিতে হয় মস্তিষ্কের কাছে, সেখানে সাদা-মাটা ভাষায় বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেই চলে। কিন্তু ভাবের বিষয়কে পৌঁছে দিতে হয় না, নানা রকম আভাস-ইঙ্গিত ছলা কলার আশ্রয়ে তাকে সৃষ্টি করে তুলতে হয়। এই যে আভাস-ইঙ্গিতপূর্ণ, ছলা-কলা সমন্বিত সৃষ্টি, এরই নাম রচনা। রচনা হল ভাবের দেহের মতো। এই দেহের সৌন্দর্যের গুণেই তাতে আশ্রিত ভাব পাঠকের কাছে আদর পায়। এছাড়া, ভাব সর্বসাধারণের, রচনাই লেখকের নিজস্ব। “সেইজন্য রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থ রূপে বাঁচিয়া থাকেন; ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে।” অবশ্য রচনা বলতে ভাব ও ভাব প্রকাশের উপায় দুই-ই সম্মিলিত ভাবে বোঝায়, তবে বিশেষ করে ঐ উপায়টাই লেখকের ভাবনা নয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যে-ভাব সকল মানুষের, সেই ভাবকে লেখক প্রথমে নিজের করে নেন, তারপর তাকে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এই হল সাহিত্য। একই ভাবকে এক-একজন লেখক তাঁদের রুচি, শিক্ষা, মানসিকতা, সামর্থ্য অনুযায়ী পৃথকভাবে গ্রহণ করতে পারেন এবং নিজের মতো করেই তার রূপ দিতে পারেন। ফলে লেখক ভেদে একই ভাবের ভিন্নরূপ সৃষ্টি সম্ভব হয়।

জ্ঞানের বিষয় ও ভাবের বিষয়ের পার্থক্য এইখানে আর একবার ধরা পড়ে। ট্রুথ বা সত্য ব্যক্তিভেদে পৃথক হতে পারে না; তা ব্যক্তি নিরপেক্ষ। কিন্তু, ভাবের বিষয় ব্যক্তিসাপেক্ষ। সূর্যোদয়কে সকলে সূর্যোদয় বলেই মানবেন, কিন্তু সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য এক একজন এক এক রকম উপভোগ করবেন। এই কারণেই চিরন্তন ভাব সকলকে অবলম্বন করে যুগে যুগে দেশে দেশে নানা জনে কত সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন। তাদের কারো রচনার সঙ্গে অন্যের কোনো রচনার মিল নেই। অথচ, তা সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাহিত্যের সামগ্রী হচ্ছে সেই সকল হৃদয়ভাব, যা সর্বসাধারণের অথচ প্রতিভাশালী স্রষ্টার হৃদয়ের সুরে ও রঙে বিশিষ্টতা লাভ করে সৃষ্টি হয়ে উঠে অন্যের হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আগে তা স্রষ্টার নিজের হয়, তারপর হয় সকলের। এই জন্যেই বলা হয়েছে, “ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য।”

Post a Comment

0 Comments